এক সময় অবিভক্ত উত্তর জেলার জেলা সদর ছিল কৈলাসহর।যা রাজ্যোর মধ্যে সর্ববৃহৎ জেলা হিসেবেই চিহ্নিত ছিল।বাম সরকারের সময়কালীন বিকেন্দ্রীকরণের ফলে রাজ্যের চারটি জেলা আটটি জেলায় পরিণত হয়েছে।আর সেদিক থেকে সবচাইতে ছোট জেলার শিরোপা আদায় করতে পেরেছে ঊনকোটি জেলা। অফিস কাছারি এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে কৈলাসহরের সাথে অভিভক্ত উত্তর জেলার মানুষের সম্পর্ক অনেকটাই ছিন্ন হয়ে পড়েছে।কিন্তু শৈবতীর্থ ঊনকোটি কিংবা খাওড়াবিলের অনুপম দৃশ্য দেখার জন্য পর্যটন পিপাসুদের বারবার হাতছানি দেয় কৈলাশহর।একদিকে চা বাগানের সবুজ বনানী অন্যদিকে শহরের বুক চিরে চলে গেছে মনু নদী। সেগুলোর টানেই দেশী -বিদেশী পর্যটকরা বারংবার চলে আসেন কৈলাশহরে। আর এই পর্যটন হল মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।প্রতিটি মানুষের কাছে নির্দিষ্ট কোন একটি পর্যটন কেন্দ্র থাকে যেখানে সে বারবার ফিরে যেতে চায়। ঠিক এমনই,কৈলাসহরের খাওড়াবিলের জলাশয়ে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠার বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।বর্তমান যুগের ব্যস্ততা সর্বস্ব জীবনের ইঁদুর দৌড়ে আমাদের শরীর ও মন যখন রোজকার একই পরিবেশের ক্লান্তি এবং একঘেয়েমিতে ভরে ওঠে,তখন নিত্যদিনের সেই চেনা চারপাশ থেকে আমাদের মনকে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দিতে এবং নিজের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি দূর করে জীবনের পরবর্তী ব্যস্ততার জন্য তৈরি হতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে ভ্রমণের।ভ্রমণ আমাদের বর্তমান জীবনের এমন একটি অংশ যাকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই ভালো থাকা যায় না।ভ্রমণ আমাদের ক্লান্তি ও গ্লানিতে ভরে ওঠা মনকে পুনরায় কোন এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সতেজ করে তোলে।মূলত শান্ত ও নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ-ই পছন্দ করেন ভ্রমণ পিপাসুরা।যেখানে একই সাথে শোনা যায় পাখীদের কলকাকলি,দেখা যায় পাহাড়ের উচ্ছতা,নদীকুলের স্নিগ্ধতা আর অরণ্যের রোমাঞ্চকর আয়োজন।জনসংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরায় এমন যায়গার কোনো অভাব নেই। রাজ্যের বেশির ভাগ অংশই পাহাড় পর্বতে ঘেরা।অনেক যায়গায় সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে পর্যটন কেন্দ্রকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে।রাজ্যের প্রায় সর্বত্র সরকারী ও বেসরকারী ভাবে কিছু কিছু পর্যটন কেন্দ্রের দিকে নজর পড়লেও রাজ্যের রাজধানী থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত প্রত্নশহর কৈলাসহরের খাওরাবিলের দিকে এখনো নজর পড়েনি কারো!অনেকেই ভাবতে পারেন খাওরাবিল সেটা আবার কোথায়?এক সময় ত্রিপুরার রাজারা উত্তর ত্রিপুরাতে(বর্তমান ঊনকোটি জেলা) কৈলাসহর থেকে রাজ্য শাসন করতেন।এক সময় রাঙাউটিতেই ছিলো রাজন্য আমলের রাজধানী। আর সেই রাঙাউঠির পাশেই প্রায় ২০০ কানি জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই বৃহৎ আকারের মৎস চাষ কেন্দ্র। কৈলাসহরের সারা বৎসরের প্রায় ৮০ শতাংশ মৎসের যোগান এখান থেকেই হয়।তৎকালীন সময়ের টিসিএস অফিসার শ্যামলীমা ব্যানার্জী ৭০টি পরিবারকে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন যার স্থাপনা হয় ২০০০ সালে।২০০ কানি জায়গায় ভূমিখনন করে গড়ে তোলা হয় মৎস চাষ কেন্দ্র যার রেজিস্ট্রেশন হয় ২০০২ সালে।দীর্ঘ ২৩ বৎসর ধরে এই মৎস চাষ কেন্দ্রটি দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে আসা অনেকেই ঘুরে গেছেন বহুবার।সরকারী কিংবা বেসরকারী ভাবে সাহায্য সহযোগীতা তেমনটা না পেলেও ধীরে ধীরে পর্যটকদের মনে যায়গা করে নিয়েছে এই মৎস চাষ কেন্দ্র। তবে ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করতে স্টুডিও বিটস্ নামক কৈলাসহরের একটি মিউজিক সংস্থা বারংবার খাউড়াবিলের রূপ যৌবনকে ক্যামেরাবন্দি করে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।পূর্বে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই খাওড়াবিল জলাশয়ে নৌকা বাইচ উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও বিগত কয়েক বছর যাবত অজানা কারণে সেটা বন্ধ রয়েছে।এই জলাশয় থেকে অল্প কিছু দুরে তৎকালীন মহারাজা ইন্দ্র মানিক্য যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর রাঙাউটি এলাকায় অস্থায়ী রাজবাড়ী নির্মান করে সেখানেই থাকতেন।যার কিছুটা ভগ্নাবশেষ এখনো সেই এলাকায় গেলে চোখে পড়ে।আজও সেখানে রয়েছে বিশাল আকারের রাজার দীঘি।সেখানে ছিল রাজার কামানডিবী অর্থাৎ অস্ত্রাগার। মহারাজা ইন্দ্র মানিক্য কৈলাসহরের খাওরাবিল এলাকা থেকেই উনি উনার রাজত্ব শাসন চালিয়েছিলেন বেশ কিছু সময়। খাওরাবিলকে পর্যটন স্থানে রুপান্তরিত করতে বাম সরকারের আমলে সমিতির পক্ষ থেকে অনেকবার লিখিত আকারে জানানো হলেও সরকার তখন কোনো হেলদোল দেখায়নি।তবে বিজেপি সরকারের হাত ধরে গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সংগঠিত হয়েছে এই সময়ের মধ্যে। কৈলাসহর পুরপুরিষদের ভাইস চেয়ারপার্সন নীতিশ দে ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসেন এই চৌদ্দ দেবতার মন্দির এবং তার পারিপার্শ্বিক এলাকার উন্নয়নের জন্য।প্রথম ধাপেই সমবায় দপ্তরের মাধ্যমে এই ধর্মীয় স্থানের রেজিস্ট্রেশন করা হয়।তারপর মন্দিরের সৌন্দর্যতা রক্ষার্থে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ,পানীয় জলের সুব্যবস্থা এবং আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।বর্তমানে একটি ভালো কিচেন এবং ডাইনিং হল নির্মাণ করার জন্য সরকারি স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে মন্দির কমিটি।এই খাওড়াবিলের চারিদিকে জলাশয় আর মাঝখানে দাড়িয়ে আছে একটি দ্বীপ।শীতের মরশুমে অনেকেই নৌকায় চড়ে এই দ্বীপের মধ্যে বনভোজন করতে আসেন।কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় নানান অসুবিধায় পড়তে হয় এখানে আসা সকলকেই।নীল আকাশের নিচে অনুপম রুপ নিয়ে দাড়িয়ে থাকা খাওরাবিলের এই অপরুপ প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকেই ক্যামেরাবন্দী করে তাদের সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ইতিমধ্যেই।সমিতির ম্যানেজার দুর্লভ নমঃ সাথে কথা বলে জানা যায় সরকারী সাহায্য সহযোগীতা না থাকায় এখানে ঘুরতে আসা পর্যটক কিংবা প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য দ্বীপের মাঝেই গড়ে তুলছেন একটি পাকা ঘর।যার কাজ সবে মাত্র শুরু হয়েছে।তিনি আরও জানান এই পাকা ঘরের পাশেই তৈরী করা হবে আরেকটি রান্নাঘর এবং এছাড়াও নিজেদের উদ্যোগে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে তোলা হবে ফুল বাগান ও হাওয়া ঘর।দুর্লভ বাবুর এই বক্তব্য শোনার পর কৈলাসহর প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে খাওরাবিলকে সাজিয়ে তুলতে এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু দাবী মৌখিক আকারেই জানানো হয় জেলা শাসক ডঃ বিশাল কুমারকে। ডঃ বিশাল কুমার প্রেস ক্লাব সদস্যদের আবেদনে সাড়া দেন এবং তিনি বলেন কিছু দিনের মধ্যেই সরকারী উদ্যোগে দ্বীপের মধ্যে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু আধুনিক আকারের ছোট ঘর করে দেওয়া হবে। তবে,ফের বিজেপি সরকার গঠন হওয়ার পর ঊনকোটি জেলায় তিনজন হেভিওয়েট মন্ত্রী থাকায় কৈলাসহরের এই খাউড়াবিল পর্যটনকেন্দ্র অন্যরকম ভাবে গড়ে উঠবে বলে বুকে একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কৈলাসহরবাসী।
105
previous post